শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা – অধ্যায় ১, শ্লোক ১
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়॥ ১॥
ধৃতরাষ্ট্র বললেন: "হে সঞ্জয়! ধর্মের ভূমি কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের ইচ্ছায় একত্রিত আমার পুত্রেরা (কৌরবরা) এবং পাণ্ডবেরা কী করল?"
এই শ্লোকটি মহাভারতের "ভীষ্মপর্ব"-এ অবস্থিত শ্রীমদ্ভগবদগীতাের প্রথম শ্লোক। এখানে ধৃতরাষ্ট্র, কৌরবদের পিতা এবং হস্তিনাপুরের অন্ধ রাজা, তাঁর সারথী সঞ্জয়কে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা জানতে চাইছেন। এই প্রশ্ন মহাভারতের যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে করা হয়েছে, যখন উভয় পক্ষ কুরুক্ষেত্রে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
শ্লোকের বিশ্লেষণ
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে:
"ধর্মের ক্ষেত্র" এবং "কুরুদের ভূমি"। কুরুক্ষেত্র কেবল একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সংঘাতের প্রতীকও বটে। এখানে "ধর্ম" এবং "অধর্ম"-এর মধ্যেকার লড়াই ঘটতে চলেছে।মহত্ত্ব: এই স্থানটি বৈদিক যজ্ঞ এবং ঋষিদের তপস্যার স্থান হিসেবে পরিচিত। তাই, যুদ্ধটিও ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘটিত হচ্ছে।
সমবেতা যুযুৎসব
"যুদ্ধের ইচ্ছায় একত্রিত"। এখানে উভয় পক্ষের মানসিকতা স্পষ্ট। কৌরব এবং পাণ্ডব উভয়েই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন।
পাণ্ডব: ধর্ম রক্ষা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
কৌরব: ক্ষমতার লোভ এবং অহংকারে অন্ধ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব:
"আমার (কৌরব) এবং পাণ্ডব"। ধৃতরাষ্ট্রের এই বাক্যাংশটি তাঁর পক্ষপাতিত্বকে প্রকাশ করে। তিনি পাণ্ডবদের "আপন" বলে মনে করেন না, যদিও তারা তাঁর ভাইপো।
মনস্তাত্ত্বিক দিক: ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব কেবল শারীরিক নয়, এটি মোহ এবং পক্ষপাতেরও প্রতীক।
কিমকুর্বত সঞ্জয়:
"কী করল, সঞ্জয়?" এই প্রশ্নটি তাঁর উদ্বেগ এবং ভয়কে প্রকাশ করে। তিনি জানেন যে কৌরবদের পতন অনিবার্য, তবুও তিনি আশা করেন যে সঞ্জয়ের উত্তর তাঁকে সান্ত্বনা দেবে।
ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের প্রতীকতত্ত্ব:
ভৌগোলিক গুরুত্ব: কুরুক্ষেত্র হরিয়ানায় অবস্থিত এবং একে "ব্রহ্মাণ্ডের নাভি" বলা হয়। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার উপদেশ দিয়েছিলেন।
আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গ: এটি মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বের (আভ্যন্তরীণ সংঘাত) প্রতীক। যেমন অর্জুনকে ধর্ম ও কর্তব্যর মধ্যে বেছে নিতে হয়, তেমনি প্রতিটি মানুষ জীবনেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দ্বিধার সম্মুখীন হয়।
ধর্ম বনাম অধর্ম: এই যুদ্ধ সত্য বনাম অসত্য, ন্যায় বনাম অন্যায়ের প্রতীক। কুরুক্ষেত্রকে "ধর্মক্ষেত্র" বলে উল্লেখ করে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে এখানে ধর্মের জয় হবে।
ধৃতরাষ্ট্রের মানসিক অবস্থা:
অন্ধত্বের প্রতীক: ধৃতরাষ্ট্রের শারীরিক অন্ধত্ব তাঁর আধ্যাত্মিক অন্ধত্বকেও নির্দেশ করে। তিনি সত্য দেখতে অস্বীকার করেন এবং পুত্রস্নাহে আবদ্ধ।
সন্দেহ ও ভয়: তাঁর প্রশ্নটি তাঁর অন্তর্দাহকে প্রকাশ করে। তিনি জানেন কৌরবদের পরাজয় নিশ্চিত, তবুও তিনি সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করে নিজেকে আশ্বস্ত করতে চান।
পক্ষপাতের ভাবনা: "মামকাঃ" (আমার) শব্দে তাঁর স্বার্থপরতা ফুটে উঠেছে। তিনি পাণ্ডবদের পরায়া ভেবে তাদের প্রতি অন্যায় করেছেন।
সঞ্জয়ের ভূমিকা:
সঞ্জয়, ধৃতরাষ্ট্রের সারথী এবং বিশ্বস্ত সহচর, মহর্ষি বেদব্যাসের কাছ থেকে দিব্য দৃষ্টি পেয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্ত ধৃতরাষ্ট্রকে বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণনা নিরপেক্ষ এবং বাস্তবনিষ্ঠ, যা ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষপাতের বিপরীত।
শ্লোকের দার্শনিক গুরুত্ব:
কর্ম ও ধর্মের সম্পর্ক: এই শ্লোক মানুষকে তার কর্মের প্রতি সচেতন করে। যেমন কৌরব ও পাণ্ডবরা তাদের কর্ম বেছে নিয়েছিল, তেমনি প্রতিটি মানুষকে তার কর্মের ফল ভোগ করতে হয়।
মোহ ও মুক্তি: ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রমোহ তাঁকে অধর্মের দিকে নিয়ে যায়, অন্যদিকে পাণ্ডবরা ধর্মে অটল থাকে।
নৈতিক দ্বন্দ্ব: এই শ্লোক প্রতিটি যুগে প্রাসঙ্গিক, কারণ মানুষ সর্বদা সঠিক ও ভুলের মধ্যে নির্বাচন করে।
আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা:
ব্যক্তিগত জীবন: প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি "কুরুক্ষেত্র" থাকে, যেখানে তাকে লক্ষ্য, মূল্যবোধ এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
সামাজিক সংঘাত: এই শ্লোক সমাজে ন্যায় ও অত্যাচারের মধ্যে চলা সংঘাতকেও নির্দেশ করে।
নেতৃত্ব ও নৈতিকতা: নেতাদের জন্য শিক্ষা যে পক্ষপাত ও অহংকার ধ্বংসের কারণ হয়।
এই শ্লোক কেবল মহাভারতের যুদ্ধের পরিচয় দেয় না, বরং মানবিক আবেগ, নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং আধ্যাত্মিক জাগরণের দর্পণও বটে। ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্ন আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করতে প্রেরণা দেয়: "আমরা আমাদের জীবনের যুদ্ধে কী করছি?"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন