সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গুরু ও শিষ্য: ধৈর্য, সাধনা ও প্রকৃত ইচ্ছার শিক্ষা

 

গুরু ও শিষ্য: ধৈর্য, সাধনা ও প্রকৃত ইচ্ছার শিক্ষা

হিমালয়ের পাদদেশে একটি নির্জন গুহায় এক জ্ঞানী গুরু বাস করতেন। তাঁর মুখে সবসময় একটি শান্ত হাসি লেগে থাকত, চোখ দুটো ছিল দীপ্তিমান এবং কণ্ঠে ছিল এক অভূতপূর্ব প্রশান্তি। বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত তাঁর আশ্রমে, তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান, জীবনের দিকনির্দেশনা ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তির সন্ধান পেতে।

তাঁর আশ্রমে অনেক শিষ্য ছিল, কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল — নাম ধরা যাক, অর্জুন। অর্জুন ছিল অত্যন্ত চঞ্চল এবং অধীর প্রকৃতির। সে সব কিছু খুব তাড়াতাড়ি পেতে চাওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিল। সে বিশ্বাস করত, যত বেশি কঠোর পরিশ্রম করা যাবে, তত দ্রুত ফল পাওয়া যাবে। সে গুরুর কাছে এসে আশ্রমে থাকার অনুমতি চেয়ে বলেছিল,

— “গুরুদেব, আমি জীবনের আসল অর্থ জানতে চাই। আমি জ্ঞানী হতে চাই, সত্য উপলব্ধি করতে চাই। অনুগ্রহ করে আমাকে শিক্ষা দিন।”

গুরু তাকে আশ্রমে থাকার অনুমতি দেন। অর্জুন প্রতিদিন কঠোর সাধনা করত — ধ্যান, শাস্ত্রপাঠ, সেবাকর্ম—সবই নিষ্ঠার সঙ্গে করত। কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই — সে ধৈর্য ধরতে পারত না। সে বারবার গুরুর কাছে এসে প্রশ্ন করত:

— “গুরুজি, আমি কতদিনে জ্ঞানী হবো?”

প্রথম কয়েকবার গুরু কেবল হেসে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু অর্জুনের এই তাগিদ ক্রমশ বেড়েই চলল। সে প্রায় প্রতিদিন এসে প্রশ্ন করতে লাগল।





🌿 একদিন গুরু বললেন:

— “ঠিক আছে অর্জুন, কাল সকালে সূর্যোদয়ের আগে তুমি আমার সঙ্গে নদীর ধারে এসো।”

পরদিন ভোরবেলা, শীতল বাতাসে আশ্রম নিঃস্তব্ধ। পাখিরা ধীরে ধীরে ডাকতে শুরু করেছে। গুরু আর অর্জুন নদীর পাড়ে এসে পৌঁছালেন। নদীর জল ছিল ঠান্ডা ও শান্ত।

গুরু বললেন,

— “চলো, আমরা জলে নামি।”

অর্জুন কিছু না ভেবেই গুরুর সঙ্গে নদীতে নেমে গেল। হঠাৎ করেই গুরু অর্জুনের মাথা দু’হাতে ধরে জলের নিচে চেপে ধরলেন! অর্জুন কিছু বোঝার আগেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। সে ছটফট করতে লাগল, হাত-পা ছুঁড়তে লাগল, জলের নিচে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল।

কিন্তু গুরু তাঁকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। প্রায় আধ মিনিট পর, যখন অর্জুনের মুখ নীল হতে শুরু করেছিল, তখন গুরু তাকে ছেড়ে দিলেন। অর্জুন জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল, কাশি শুরু করল, ভয় আর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল গুরুর দিকে।

🌊 গুরু শান্তভাবে বললেন:

— “এই মুহূর্তে তুমি সবচেয়ে বেশি কী চেয়েছিলে?”

অর্জুন বলল, হাফাতে হাফাতে:

— “শ্বাস নিতে, গুরুজী! শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম!”

গুরু মৃদু হেসে বললেন:

— “যেদিন তুমি জ্ঞান, সত্য বা সাফল্যকে ততটাই তীব্রভাবে চাও—যতটা তুমি একটু আগে বাঁচার জন্য শ্বাস নিতে চেয়েছিলে—সেদিনই তুমি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করবে।”

এই কথা শুনে অর্জুন নিঃশব্দে বসে পড়ল। তার চোখে জল। সে বুঝতে পারল, এতদিন সে শুধু ফল চাইছিল, কিন্তু প্রকৃত ইচ্ছা, গভীর তৃষ্ণা তার ছিল না। তার সাধনায় ছিল নিয়ম, কিন্তু ছিল না হৃদয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

🌟 সত্যিকারের ইচ্ছা কেমন হওয়া উচিত?

আমরা অনেক সময় জীবনে কিছু পেতে চাই — সফলতা, জ্ঞান, অর্থ, খ্যাতি — কিন্তু সেই চাওয়ার গভীরতা কতটা? আমরা কি সত্যিই সেই জিনিসটির জন্য নিজেদের সব কিছু উজাড় করে দিতে প্রস্তুত? নাকি আমরা শুধু চাইলেই সেটা পেয়ে যাব ভাবি?

গুরুর শিক্ষা ছিল খুব স্পষ্ট — কোনো মহান অর্জনের জন্য শুধু নিয়ম বা প্রচেষ্টা নয়, প্রয়োজন হয় অন্তরের গভীর আকাঙ্ক্ষা, ধৈর্য এবং সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা।

অর্জুনের গল্প আমাদের শেখায়, জ্ঞান বা সফলতা এমন কিছু নয় যা কেউ আমাদের হাতে তুলে দেবে। সেটি অর্জন করতে হয় নিজের নিঃস্বার্থ সাধনার মাধ্যমে। একে শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রচেষ্টায় পাওয়া যায় না — চাই আত্মিক নিবেদন

🍁 অর্জুনের পরিবর্তন

সেই দিন থেকে অর্জুন আর কখনো জিজ্ঞেস করেনি, “আমি কবে জ্ঞানী হবো?” সে ধীরে ধীরে বুঝতে শিখল যে প্রতিটি দিনই একটি নতুন শিক্ষা, প্রতিটি মুহূর্তেই আত্ম-উন্নয়ন সম্ভব। সে আর তাড়াহুড়া করত না, বরং নিজের প্রতিটি কাজেই সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে লাগল।

কয়েক বছর পরে সে নিজেও একজন গুরু হয়ে উঠল, যাঁর শিষ্যরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে “জ্ঞানদাতা” বলে সম্বোধন করত।

🔔 পাঠকদের উদ্দেশে কিছু প্রশ্ন:

  • আপনি যা চান জীবনে, তার জন্য আপনি কীভাবে প্রস্তুত?

  • আপনি কী সত্যিই নিজের স্বপ্নের জন্য যথেষ্ট গভীরভাবে তৃষ্ণার্ত?

  • আপনি কি শুধু চেষ্টা করছেন, নাকি নিজের সর্বস্ব দিয়ে পথ চলছেন?


🔖 উপসংহার

এই গল্পটি শুধুই একজন শিষ্যের নয়। এটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমরা সবাই চাই জীবনে কিছু পেতে — কেউ চাই সফলতা, কেউ শান্তি, কেউ ভালোবাসা। কিন্তু সেই পাওয়ার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত?

ধৈর্য, তীব্র ইচ্ছা, এবং আত্ম-নিবেদন — এই তিনটি যদি থাকে, তাহলে যেকোনো কিছুই সম্ভব।

“তোমার ইচ্ছা যত গভীর, তোমার পথ তত প্রশস্ত।”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রেরণার গল্প , কৃষকের অলস তিন ছেলে |Motivational Story in Bengali ,Farmer's lazy three sons

একটি গ্রামে এক কৃষক ছিল । সে মধ্যবিত্ত ছিল ,মধ্যবিত্তি হলেও সে অনেক প্ররিশ্রমী ছিল । সে প্ররিশ্রম করতে ভালোবাস্তো ।ঘরে বসে থাকতে চাইতো না । অলসভাবে বসে থাকতে সে ঘৃণা করতো । কৃষকের স্ত্রী - সেও খুব পরিশ্রমী । দিনরাত স্বামীর সংগে সে পরিশ্রম করে । এমন করে দিন যায় । কৃষকের তিন পুত্র । কিন্তু তিনটি পুত্র হলো খুব অলস । খায় - দায় ,গল্প করে ,গান গায় ঘুরে বেড়ায় - কারও কাজে মন নেই এতটুকু । কৃষক তাদের কাজ শেখালো । কি করে মাটি কুপাতে হয় ,মোই দিতে দিতে হয় , চাষ করতে হয় , বীজ বুনতে হয় ,সব শিখলো তারা । কিন্তু কেউ কাজ করতো না । তারা জানতো সব, কিন্তু করতো না কিছু । গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতে তারা খুব ভালোবাসে । একদিন কৃষক গিন্নি কৃষকে বললো - শুনছ  গো ?- কি বলছো ? দেখছো ছেলেদের কান্ড ? হ্যাঁ ।  ছেলেরা ওরকম কুরে হলে তো দুদিনে বসে খেয়ে সব উড়িয়ে দেবে । তারপর কি হবে ? কৃষক চুপ করে রইলো । কিছুক্ষণ পরে শুধু একটু হেসে বললো - ঠিক সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে । এমন হবে দিন যায় । কৃষক গিন্নি স্বামীর কোথায় চুপ করে থাকে ।  দেখতে দেখতে কৃষক বৃদ্ধ হয়ে পড়লো । তখন সে একদিন স্ত্রীকে ডেকে বললো -...

অনুপ্রেরণামূলক গল্প গৌতম বুদ্ধ Inspirational Story Gautam Buddha

একবার গৌতম বুদ্ধ ,বুদ্ধ ধর্মের শিক্ষা প্রচারের জন্য গ্রাম গ্রাম শহর শহর নিজের শিষ্য দেড় নিয়ে ঘুরছিলেন ,পুরোদিন ঘুরতে ঘুরতে গৌতম বুদ্ধের জল পিপাসা পেয়ে গেলো ,জল পিপাসা এতই বেড়ে গেলো যে তিনি আর সহ্য করতে পড়তে ছিলেন না । তাই তিনি তার একজন শিষ্য কে ডেকে বললেন যে তার অনেক পিপাসা পেয়েছে তাই তার জন্য জল আনার জন্য । শিষ্য গুরুর আদেশে জল আনার জন্য গ্রামের ভিতরে গেলো ,গ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি নদী বইছিল । কিন্তু সেই নদীতে গ্রামের সবাই কাপড় ধুইছিলো ,কেউ গরু ,মহিষ কে স্নান করাচ্ছিল ,তাই নদীর জল অপরিস্খার ছিল ,তাই শিষ্য চিন্তা করলো এই জল তো অপররিস্খার তার গুরুদেবের জন্য এই  অপরিস্খার জল নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না ,তাই শিষ্য জল না নিয়ে খালি হাতে চলে গেলো ,গৌতম বুদ্ধা যখন শিষ্য কে খালি হাথে চলে আসতে দেখেন তখন খালি হাতে আসার কারণ জিগ্গেস করেন ,তখন শিষ্য পুরো কাহিনী বলেন ।  এইদিকে গুরুদেবের পিপাসাতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ,গৌতম বুদ্ধা তখন আরেকজন শিষ্যকে জল আনার জন্য বলেন তখন সেই শিষ্য একটি   মাটির পাত্রতে পরিস্খার জল নিয়ে আসে ,তা দেখে গৌতম বুদ্ধা অভাক হয়ে গেলেন এবং এব...

গৌতম বুদ্ধের অনুপ্রেরণার কাহিনী । জীবন বদলে দেবে এই কাহিনী

  এক গরিব দুঃখী বেক্তির জীবন পরিবর্তনের কাহিনী ।.   আমরা জীবনে এই নিয়ে দুঃখিত থাকি যে  ইহার কারণ কি ?আমরা সবাই এটাই সবসময় মনে করে থাকি ,আমি  অন্যদের থেকে অনেক দুঃখিত ,অনেক কষ্ট করছি ,জীবনে কষ্ট সবচেয়ে বেশি আমার । অন্যরা আমার থেকে অনেক সুখে আছে ,শান্তিতে আছে , কিন্তু আমাদের এই চিন্তা ভুল । ভগবান আমাদের জন্মের সাথে সাথে জীবনে ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন সবকিছু দিয়ে দিয়েছেন । ভগবান গৌতম বুদ্বের এই গল্প থেকে বুজতে পারবো । গৌতম বুদ্ধ  একবার  তার শিষ্যদের সাথে একটি গ্রামে গিয়েছিলেন । সেই গ্রামের লোকেরা তাদের সমষ্যা নিয়ে গৌতম বুদ্ধের কাছে যেত এবং তাদের সমস্যার সমাধান নিয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফায়ার যেত । ওই গ্রামের রাস্তার ধরে একটি লোক বসে থাকতো এবং গৌতম বুদ্বের কাছে আসা প্রতিটি লোককে খুব মনোযোগ সহকারে  লক্ষ্য  করতো , সে এটা দেখে খুব অবাক হতো যে লোকতো  আসে অনেক মন খারাপ নিয়ে , কিন্তু যখন তারা গৌতম বুদ্ধের দর্শন করে ফিরত তারা অনেক খুশি থাকত , এবং মুখে থাকতো একটা হাসি ।  তাই গরিব ব্যক্তিটি মনে মনে ভাবলো যদি আমিও আমার সমস্যার কথা গৌত...