সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেরণা: “কর্মে মন দাও, ফল ঈশ্বরের হাতে”

 

🌼 ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেরণা: “কর্মে মন দাও, ফল ঈশ্বরের হাতে” 🌼

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা—এটি কেবল একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি এক মহৎ জীবনদর্শনের উৎস। যুগে যুগে জ্ঞানীরা, নেতা, সাধকরা এই মহাগ্রন্থ থেকে জীবনের পথে চলার জন্য দিশা পেয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি মূল মন্ত্র হল:

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
বাংলা অনুবাদ: তোমার অধিকার শুধু কর্ম করার উপর, কখনোই তার ফলের উপর নয়।

এই একটি বাক্যই জীবনকে বদলে দেওয়ার মতো শক্তিশালী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনকে এই কথা বলেন, যখন অর্জুন তাঁর কর্তব্য থেকে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে বোঝান, জীবনের সঠিক পথে চলতে হলে আমাদের উচিত হবে ফলের আশা না করে, মনপ্রাণ দিয়ে কর্ম করে যাওয়া।



🎯 কেন ফলের চিন্তা না করে কেবল কর্মে মনোযোগ দেওয়া উচিত?

আমরা যখন কোনো কাজ করি, তখন প্রায়শই আমাদের মন সেই কাজের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়েই ব্যস্ত থাকে—“সফল হব তো?”, “সম্মান পাব তো?”, “অর্থ আসবে তো?” এইসব ভাবনা আমাদের কর্মে ব্যাঘাত ঘটায়। আমরা চিন্তায় এতটাই ডুবে যাই যে কাজটাকেই ঠিকভাবে করা হয় না।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই ধরণের ফলের আসক্তিই আমাদের দুঃখ, হতাশা, ভয় এবং অনিশ্চয়তার মূল। কারণ ফল আমাদের হাতে নয়। আমরা কেবল চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু ফলাফল নির্ধারণ করেন ঈশ্বর বা প্রকৃতি।

🌱 উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক

একজন কৃষক বীজ বপন করে। সে নিয়মিত জল দেয়, যত্ন নেয়। কিন্তু সে জানে না—আবহাওয়া কেমন হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে কিনা, ফসল উঠবে কিনা। তবুও সে নিজের কর্মে নিয়োজিত থাকে। কারণ সে জানে, যদি সে কাজ না করে, তবে ফল তো আসবেই না।

একইভাবে, একজন ছাত্র যদি পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়, তাহলে সে সফল হবার সম্ভাবনা তৈরি করে। কিন্তু যদি সে সারাক্ষণ রেজাল্ট নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, তাহলে মনসংযোগ নষ্ট হয়, এবং পারফরম্যান্স খারাপ হয়।

🧘‍♂️ কর্মযোগ: আত্মনিয়ন্ত্রণ ও কর্তব্যবোধ

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গীতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনের কথা বলেন—কর্মযোগ
কর্মযোগ মানে হচ্ছে: নির্লিপ্তভাবে, ফলের আশা ছাড়াই নিজের কর্তব্য পালন করা। এই ভাবধারাটি আমাদের শেখায়, কিভাবে প্রতিটি কাজকে উপাসনার মত করে দেখতে হয়। আমাদের নিজের কর্মই যেন হয় সাধনা।

যখন আমরা ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান না ভেবে সমাজ, পরিবার, ও নিজের কর্তব্যপালনে মন দিই, তখন আমাদের কাজেই আসে সফলতা, শান্তি ও তৃপ্তি।

🌀 “ফল” কেন আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়?

১. বহু উপাদানের উপর ফল নির্ভর করে: শুধু আমাদের চেষ্টা নয়, বরং সময়, পরিস্থিতি, অন্যদের আচরণ, ভাগ্য—এসবই মিলেই কোনো কাজের ফল নির্ধারণ করে।

২. অহং থেকে মুক্তি পাওয়া যায়: যখন আমরা মনে করি, “আমি কাজ করলাম, তাই ফল আসবেই”—তখন সেটা অহংকারে পরিণত হয়। কর্মযোগ আমাদের শেখায় বিনয়।

৩. মানসিক শান্তি বজায় থাকে: ফল নিয়ে দুশ্চিন্তা না থাকলে আমরা বর্তমানে বাঁচতে শিখি। উদ্বেগ কমে, হতাশা কমে।

💬 আধুনিক জীবনে শ্রীকৃষ্ণের বাণী কতটা প্রাসঙ্গিক?

বর্তমানে আমরা এক প্রতিযোগিতামূলক সমাজে বাস করি, যেখানে সবাই সাফল্য, অর্থ, খ্যাতির পেছনে দৌড়াচ্ছে। এর ফলে অনেকেই মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অবসাদে ভুগছে। এই সময়ে শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী যেন এক শান্তির বাতিঘর।

যে ব্যক্তি শুধুমাত্র কাজ করে যায় নিষ্ঠার সাথে, সে ধীরে ধীরে তার গন্তব্যে পৌঁছায়। ফল নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে, যদি আমরা নিজেকে আত্মোন্নয়নে, দক্ষতা বৃদ্ধিতে, মানবসেবায় নিয়োজিত করি, তাহলে সফলতা আমাদের পথ অনুসরণ করবে।

🌸 ভগবান কৃষ্ণের শিক্ষার কিছু মূল দিক:

  1. আত্মসমর্পণ: আমরা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাই ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখা ও নিজের দায়িত্ব পালন করাই শ্রেষ্ঠ পথ।

  2. স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থা: পরিস্থিতি যেমনই হোক, আমাদের মন যেন স্থির থাকে। আনন্দে উচ্ছ্বসিত না হওয়া এবং দুঃখে ভেঙে না পড়া—এই ভারসাম্যই গীতা শেখায়।

  3. নিরাসক্তি: কাজের প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ, কিন্তু তার ফলাফল বা প্রতিদান নিয়ে কোনো আসক্তি নয়—এই ভাবধারাই আমাদের সত্যিকারের শান্তির পথে নিয়ে যায়।

🌼 একজন কর্মযোগীর জীবন কেমন?

একজন কর্মযোগী তার জীবনের প্রতিটি দায়িত্বকে পূর্ণ মনোযোগ ও আন্তরিকতার সাথে পালন করেন। তিনি জানেন, নিজের সৎ প্রচেষ্টাই যথেষ্ট। তিনি অন্যকে দোষ দেন না, ভাগ্যকে দোষ দেন না। তিনি নিজের কর্তব্য পালন করে যান নীরবে। এমন ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস, মানসিক শান্তি ও অধ্যবসায়ের এক গভীর সমাহার থাকে।

📿 কৃষ্ণের দর্শন আমাদের কী শেখায়?

১. কঠোর পরিশ্রম ও ধৈর্য: সফলতা হঠাৎ আসে না। ত্যাগ, অধ্যবসায় ও ধৈর্য লাগে।

২. মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা: নিজের কর্ম যদি সমাজের উপকারে আসে, তবে সেটাই প্রকৃত সেবা।

৩. আত্মবিশ্বাস: ভগবদ্‌গীতার শিক্ষা আত্মবিশ্বাস তৈরি করে, কারণ এটি বলে—আমরা যদি সৎ পথে চলি, তবে কোনো কিছুই আমাদের আটকাতে পারবে না।

🌈 উপসংহার

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেবল একজন পৌরাণিক দেবতা নন, তিনি একজন আধ্যাত্মিক গুরু, একজন মহান মনোবিজ্ঞানী ও চিরন্তন দার্শনিক। তাঁর “কর্মে মন দাও, ফলের চিন্তা করো না”—এই বাণী আজও আমাদের জীবনে আলো দেখাতে সক্ষম। যেসব মানুষ আজও এই দর্শন মেনে চলে, তারা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বেশি স্থির, ধৈর্যশীল ও আত্মনির্ভর হন।

তাই আসুন, আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই অনন্ত সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করি। প্রতিদিনের জীবনে কাজে নিয়োজিত হই পূর্ণ মনোযোগ ও নিষ্ঠার সাথে। ফল যাই হোক, যদি কর্ম সৎ হয়—সফলতা একদিন নিশ্চিত আসবেই।


জয় শ্রীকৃষ্ণ। 🙏

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রেরণার গল্প , কৃষকের অলস তিন ছেলে |Motivational Story in Bengali ,Farmer's lazy three sons

একটি গ্রামে এক কৃষক ছিল । সে মধ্যবিত্ত ছিল ,মধ্যবিত্তি হলেও সে অনেক প্ররিশ্রমী ছিল । সে প্ররিশ্রম করতে ভালোবাস্তো ।ঘরে বসে থাকতে চাইতো না । অলসভাবে বসে থাকতে সে ঘৃণা করতো । কৃষকের স্ত্রী - সেও খুব পরিশ্রমী । দিনরাত স্বামীর সংগে সে পরিশ্রম করে । এমন করে দিন যায় । কৃষকের তিন পুত্র । কিন্তু তিনটি পুত্র হলো খুব অলস । খায় - দায় ,গল্প করে ,গান গায় ঘুরে বেড়ায় - কারও কাজে মন নেই এতটুকু । কৃষক তাদের কাজ শেখালো । কি করে মাটি কুপাতে হয় ,মোই দিতে দিতে হয় , চাষ করতে হয় , বীজ বুনতে হয় ,সব শিখলো তারা । কিন্তু কেউ কাজ করতো না । তারা জানতো সব, কিন্তু করতো না কিছু । গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতে তারা খুব ভালোবাসে । একদিন কৃষক গিন্নি কৃষকে বললো - শুনছ  গো ?- কি বলছো ? দেখছো ছেলেদের কান্ড ? হ্যাঁ ।  ছেলেরা ওরকম কুরে হলে তো দুদিনে বসে খেয়ে সব উড়িয়ে দেবে । তারপর কি হবে ? কৃষক চুপ করে রইলো । কিছুক্ষণ পরে শুধু একটু হেসে বললো - ঠিক সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে । এমন হবে দিন যায় । কৃষক গিন্নি স্বামীর কোথায় চুপ করে থাকে ।  দেখতে দেখতে কৃষক বৃদ্ধ হয়ে পড়লো । তখন সে একদিন স্ত্রীকে ডেকে বললো -...

অনুপ্রেরণামূলক গল্প গৌতম বুদ্ধ Inspirational Story Gautam Buddha

একবার গৌতম বুদ্ধ ,বুদ্ধ ধর্মের শিক্ষা প্রচারের জন্য গ্রাম গ্রাম শহর শহর নিজের শিষ্য দেড় নিয়ে ঘুরছিলেন ,পুরোদিন ঘুরতে ঘুরতে গৌতম বুদ্ধের জল পিপাসা পেয়ে গেলো ,জল পিপাসা এতই বেড়ে গেলো যে তিনি আর সহ্য করতে পড়তে ছিলেন না । তাই তিনি তার একজন শিষ্য কে ডেকে বললেন যে তার অনেক পিপাসা পেয়েছে তাই তার জন্য জল আনার জন্য । শিষ্য গুরুর আদেশে জল আনার জন্য গ্রামের ভিতরে গেলো ,গ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি নদী বইছিল । কিন্তু সেই নদীতে গ্রামের সবাই কাপড় ধুইছিলো ,কেউ গরু ,মহিষ কে স্নান করাচ্ছিল ,তাই নদীর জল অপরিস্খার ছিল ,তাই শিষ্য চিন্তা করলো এই জল তো অপররিস্খার তার গুরুদেবের জন্য এই  অপরিস্খার জল নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না ,তাই শিষ্য জল না নিয়ে খালি হাতে চলে গেলো ,গৌতম বুদ্ধা যখন শিষ্য কে খালি হাথে চলে আসতে দেখেন তখন খালি হাতে আসার কারণ জিগ্গেস করেন ,তখন শিষ্য পুরো কাহিনী বলেন ।  এইদিকে গুরুদেবের পিপাসাতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ,গৌতম বুদ্ধা তখন আরেকজন শিষ্যকে জল আনার জন্য বলেন তখন সেই শিষ্য একটি   মাটির পাত্রতে পরিস্খার জল নিয়ে আসে ,তা দেখে গৌতম বুদ্ধা অভাক হয়ে গেলেন এবং এব...

গৌতম বুদ্ধের অনুপ্রেরণার কাহিনী । জীবন বদলে দেবে এই কাহিনী

  এক গরিব দুঃখী বেক্তির জীবন পরিবর্তনের কাহিনী ।.   আমরা জীবনে এই নিয়ে দুঃখিত থাকি যে  ইহার কারণ কি ?আমরা সবাই এটাই সবসময় মনে করে থাকি ,আমি  অন্যদের থেকে অনেক দুঃখিত ,অনেক কষ্ট করছি ,জীবনে কষ্ট সবচেয়ে বেশি আমার । অন্যরা আমার থেকে অনেক সুখে আছে ,শান্তিতে আছে , কিন্তু আমাদের এই চিন্তা ভুল । ভগবান আমাদের জন্মের সাথে সাথে জীবনে ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন সবকিছু দিয়ে দিয়েছেন । ভগবান গৌতম বুদ্বের এই গল্প থেকে বুজতে পারবো । গৌতম বুদ্ধ  একবার  তার শিষ্যদের সাথে একটি গ্রামে গিয়েছিলেন । সেই গ্রামের লোকেরা তাদের সমষ্যা নিয়ে গৌতম বুদ্ধের কাছে যেত এবং তাদের সমস্যার সমাধান নিয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফায়ার যেত । ওই গ্রামের রাস্তার ধরে একটি লোক বসে থাকতো এবং গৌতম বুদ্বের কাছে আসা প্রতিটি লোককে খুব মনোযোগ সহকারে  লক্ষ্য  করতো , সে এটা দেখে খুব অবাক হতো যে লোকতো  আসে অনেক মন খারাপ নিয়ে , কিন্তু যখন তারা গৌতম বুদ্ধের দর্শন করে ফিরত তারা অনেক খুশি থাকত , এবং মুখে থাকতো একটা হাসি ।  তাই গরিব ব্যক্তিটি মনে মনে ভাবলো যদি আমিও আমার সমস্যার কথা গৌত...